আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘মুক্ত’ খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুতই বিদেশে উন্নত সেন্টারে নিতে চায় বিএনপি ও তার পরিবার। তবে দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সামলানোর অবস্থায় না থাকায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিলম্ব হচ্ছে। শারীরিক সামর্থ্যের উন্নতি হলেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দল এবং খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হলেও শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে তাকে ঢাকা থেকে স্বল্প দূরত্বের কোনো দেশে নেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংকক পছন্দ তাদের। সেখানে শারীরিক অবস্থার উন্নতি সাপেক্ষে বেগম জিয়াকে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ম্যাডাম প্রায় দেড় মাসের মতো এভাকেয়ার হাসপাতালে আছেন। গত দুদিন ধরে ওনার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল বলা যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তাকে থাকতে হয়। এখন সিসিইউর সুবিধা সমেত কেবিনে তার চিকিৎসা চলছে।’ বিদেশে মাল্টিপল সেন্টারে উনাকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকার এটা কর্ণপাত করেনি। এখন সেই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে, ম্যাডাম মুক্তি পেয়েছেন। আমরা এখন তাকে বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। তবে এখনো কোনোকিছুই চূড়ান্ত হয়নি।
এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ছাড়াও হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন। ‘হঠাৎ অসুস্থ বোধ করায়’ গত ৮ জুলাই ভোররাতে তাকে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে বসুন্ধরার এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে থেকেই গত ৬ আগস্ট স্থায়ী মুক্তির সুসংবাদ পান তিনি। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে একটা সুসংবাদ দিতে চাই। আল্লাহ যদি রহম করেন, ম্যাডামকে আমরা অতি শিগগিরই বিদেশে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা উনার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করব, যাতে উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন।’ মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যের পর ‘মুক্ত’ খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে।
চিকিৎসকরা এর আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও জার্মানী এই তিন দেশের যেকোনো একটিতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জানা গেছে, বিএনপি এবং বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। কারণ, গত বছরের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশে এসে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার যকৃতে ‘ট্র্যান্সজাগুলার ইন্ট্রাহেপেটিক পোরটোসিসটেমিক শান্ট (টিপস)’ সম্পন্ন করেন। তবে এই মুহূর্তে টানা ১০-১৫ ঘন্টা ভ্রমণ করার মতো শারীরিক অবস্থা নেই খালেদা জিয়ার। এ দিক থেকে আকাশ পথে স্বল্প দূরত্ব বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে তাকে সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ডে নেওয়া হতে পারে। সম্প্রতি দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান। যদিও বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় তাকে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি সরকার ও সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনে খালেদা জিয়াকে নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া এবং দেশের বাইরে না যাওয়ার শর্তে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়। গত ৬ আগস্ট বঙ্গভবনের প্রজ্ঞাপনে স্থায়ী মুক্তির আগ পর্যন্ত তার সেই সাময়িক মুক্তির মেয়াদ প্রতি ছয় মাস পরপর বাড়ানো হয়।